আল-আমিন হোসেন: বৃহত্তর কুষ্টিয়ার কিংবদন্তীতুল্য মুক্তিযোদ্ধা, আলমডাঙ্গা থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার কাজী কামাল। বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথায় সাধারণ মানুষ সর্বাগ্রে যার নাম স্মরণ করেন তিনি কাজী কামাল। ‘৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি আলমডাঙ্গা থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডারের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, ‘৬৬ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘৭০ সালে নিজ উদ্যোগে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হান্নান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আশু, মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান, অগ্নি-সেনা মঈন উদ্দীনসহ বহু ছাত্রনেতা তার নেতৃত্বে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।তারই শিষ্য অগ্নি-সেনা মইনুদ্দিন আহমেদ যুদ্ধের পূর্বে ৭০ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার আগেই কোন কিছু করেনি পরোয়া, পাকিস্তানের পতাকায় আগুন দিয়ে পেতে হয়েছিল সাজা। তার শিষ্য বলে নিজের পরিচয় দিতে ভালবাসেন এমন একাধিক মুক্তিযোদ্ধা আছে। ’৭১ সালে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন থেকে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়েছিলেন এবং নিজ বাড়িতে রাইফেল ট্রেনিং দিতেন।
যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠলে তৎকালীন আওয়ামীলীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাফায়েত-উল ইসলাম, ডাঃ শাহাবুদ্দিনসহ অনেককেই সাথে নিয়ে আলমডাঙ্গা কলেজে কন্ট্রোল-রুম তৈরী করেছিলেন। তার অমিত বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে আলমডাঙ্গা থানার সমস্ত রাইফেল লুট করে স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কুষ্টিয়াকে পাক হানাদার মুক্ত করতে মরণপণ যুদ্ধ শুরু করেন। আরও ভাল প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে ট্রেনিং শেষে দেরাদুনে যান উচ্চ প্রশিক্ষণে। পাহাড়ি অঞ্চলে জীবন-বাজি রেখে উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে যে সকল মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যেতে সক্ষম হয়নি, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করতেন।
বিস্ময়কর কাকিলাদহ’র ভয়াবহ যুদ্ধে তিনি কমান্ডিং’এর দায়িত্ব পালন করেন এবং সে সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি । বঙ্গবন্ধু কাজী কামালকে তৎকালীন থানা গভর্নর করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর নিকটতম লোক ছিলেন কাজী কামাল। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তার পরিবারেও দুষ্প্রাপ্য অত্যাচার নেমে এসেছিল। জীবন রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে ভারতে পারি জমাতে হয়েছিল । ষড়যন্ত্রে ভাই কাজী রবিউলকেও সেই সময় ফাঁসির আসামি পর্যন্ত হতে হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার পরিবারকে যতটা না অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ৭৫ সালের পরে তার পরিবারের উপর নেমে এসেছিল আরো ভয়াবহ অত্যাচার। সময় বহমান অবশেষে অপেক্ষার অবসান। স্বাধীনতার পর কুমারী ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলেন তিনি।
কুমারী ভেটেরেনারি কলেজ নির্মাণে তারই ভূমিকা ছিল সবথেকে বেশি।এমনকি আলমডাঙ্গা কৃষি ব্যাংক স্থাপনে এবং আলমডাঙ্গা থেকে হাটবোয়ালিয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগসহ যুদ্ধের পর দেশ পূর্ণ গঠনের একাধিক অবদান রেখেছিলেন তিনি।অনেকে বলে থাকে আলমডাঙ্গা তে যদি আওয়ামী লীগের গোড়া পত্তন হয়ে থাকে তাহলে সেই শিকর হলো কাজী কামাল বাড়ি থেকে হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো বর্তমান তার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কেও জানেনা।এমনকি তার নামে আলমডাঙ্গাতে কোন সড়ক বা রাস্তারও নামকরন হয়নি। ৭১ সালে জীবন বাজী রেখে যে মানুষ আলমডাঙ্গাবাসীকে এতোকিছু দিল আর আজ সেই মানুষের নাম মলিন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন ।সোনায় যেমন একটু পানি মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেইরকম ভালবাসার সঙ্গে একটু শ্রদ্ধা, ভক্তি না মিশালে সে ভালবাসাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
তার পরিবারের সদস্যদের একমাত্র চাওয়া স্বাধীনতা স্বপক্ষে সরকার ক্ষমতা থাকার পরেও এমন একটা মানুষের ইতিহাস দিন দিন বিলীন হতে চলছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক । তবে সব মিলিয়ে মানুষ তাকে যারা চিনতো বা জানতো তাকে মনে রাখবেন- একজন নির্লোভ ও অমিত তেজস্বী আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল ৭২ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে আলমডাঙ্গা বাবুপাড়াতে কাজী কামালের একমাত্র কন্যা, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মারজাহান নিতু এবং দুই পুত্র (চন্দন ওধ্রুব)। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল ছিলেন দৌলতপুর উপজেলার ছাতারপাড়া গ্রামের মৃত কাজী সিরাজুল হকের বড় ছেলে । তার নানার বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার সুতাইল গ্রামে।